Search

Showing posts with label কাজী নজরুল ইসলাম. Show all posts
Showing posts with label কাজী নজরুল ইসলাম. Show all posts

দারিদ্র্য

কাজী নজরুল ইসলাম



হে দারিদ্র্য, তুমি মোরে করেছ মহান্।
তুমি মোরে দানিয়াছ খ্রীষ্টের সম্মান
কন্টক-মুকুট শোভা।-দিয়াছ, তাপস,
অসঙ্কোচ প্রকাশের দুরন্ত সাহস;
উদ্ধত উলঙ্গ দৃষ্টি, বাণী ক্ষুরধার,
বীণা মোর শাপে তব হ’ল তরবার!
দুঃসহ দাহনে তব হে দর্পী তাপস,
অম্লান স্বর্ণেরে মোর করিলে বিরস,
অকালে শুকালে মোর রূপ রস প্রাণ!


শীর্ণ করপুট ভরি’ সুন্দরের দান
যতবার নিতে যাই-হে বুভুক্ষু তুমি
অগ্রে আসি’ কর পান! শূন্য মরুভূমি
হেরি মম কল্পলোক। আমার নয়ন
আমারি সুন্দরে করে অগ্নি বরিষণ!
বেদনা-হলুদ-বৃন্ত কামনা আমার
শেফালির মত শুভ্র সুরভি-বিথার
বিকশি’ উঠিতে চাহে, তুমি হে নির্মম,
দলবৃন্ত ভাঙ শাখা কাঠুরিয়া সম!

 

আশ্বিনের প্রভাতের মত ছলছল
ক’রে ওঠে সারা হিয়া, শিশির সজল
টলটল ধরণীর মত করুণায়!
তুমি রবি, তব তাপে শুকাইয়া যায়
করুণা-নীহার-বিন্দু! ম্লান হ’য়ে উঠি
ধরণীর ছায়াঞ্চলে! স্বপ্ন যায় টুটি’
সুন্দরের, কল্যাণের। তরল গরল
কন্ঠে ঢালি’ তুমি বল, ‘অমৃতে কি ফল?
 
জ্বালা নাই, নেশা নাই, নাই উন্মাদনা,-
রে দুর্বল, অমরার অমৃত-সাধনা
এ দুঃখের পৃথিবীতে তোর ব্রত নহে,
তুই নাগ, জন্ম তোর বেদনার দহে।
কাঁটা-কুঞ্জে বসি’ তুই গাঁথিবি মালিকা,
দিয়া গেনু ভালে তোর বেদনার টিকা!….
গাহি গান, গাঁথি মালা, কন্ঠ করে জ্বালা,
দংশিল সর্বাঙ্গে মোর নাগ-নাগবালা!…..
 
ভিক্ষা-ঝুলি নিয়া ফের’ দ্বারে দ্বারে ঋষি
ক্ষমাহীন হে দুর্বাসা! যাপিতেছে নিশি
সুখে রব-বধূ যথা-সেখানে কখন,
হে কঠোর-কন্ঠ, গিয়া ডাক-‘মূঢ়, শোন্,
ধরণী বিলাস-কুঞ্জ নহে নহে কারো,
অভাব বিরহ আছে, আছে দুঃখ আরো,
আছে কাঁটা শয্যাতলে বাহুতে প্রিয়ার,
তাই এবে কর্ ভোগ!-পড়ে হাহাকার
নিমেষে সে সুখ-স্বর্গে, নিবে যায় বাতি,
কাটিতে চাহে না যেন আর কাল-রাতি!

 

চল-পথে অনশন-ক্লিষ্ট ক্ষীণ তনু,
কী দেখি’ বাঁকিয়া ওঠে সহসা ভ্রূ-ধনু,
দু’নয়ন ভরি’ রুদ্র হানো অগ্নি-বাণ,
আসে রাজ্যে মহামারী দুর্ভিক্ষ তুফান,
প্রমোদ-কানন পুড়ে, উড়ে অট্টালিকা,-
তোমার আইনে শুধু মৃত্যু-দন্ড লিখা!
বিনয়ের ব্যভিচার নাহি তব পাশ,
তুমি চান নগ্নতার উলঙ্গ প্রকাশ।
সঙ্কোচ শরম বলি’ জান না ক’ কিছু,
উন্নত করিছ শির যার মাথা নীচু।
মৃত্যু-পথ-যাত্রীদল তোমার ইঙ্গিতে
গলায় পরিছে ফাঁসি হাসিতে হাসিতে!

 

নিত্য অভাবের কুন্ড জ্বালাইয়া বুকে
সাধিতেছ মৃত্যু-যজ্ঞ পৈশাচিক সুখে!
লক্ষ্মীর কিরীটি ধরি, ফেলিতেছ টানি’
ধূলিতলে। বীণা-তারে করাঘাত হানি’
সারদার, কী সুর বাজাতে চাহ গুণী?
যত সুর আর্তনাদ হ’য়ে ওঠে শুনি!
প্রভাতে উঠিয়া কালি শুনিনু, সানাই
বাজিছে করুণ সুরে! যেন আসে নাই
আজো কা’রা ঘরে ফিরে! কাঁদিয়া কাঁদিয়া
ডাকিছে তাদেরে যেন ঘরে ‘সানাইয়া’!
বধূদের প্রাণ আজ সানা’য়ের সুরে
ভেসে যায় যথা আজ প্রিয়তম দূরে
আসি আসি করিতেছে! সখী বলে, ‘বল্
মুছিলি কেন লা আঁখি, মুছিলি কাজল?….
শুনিতেছি আজো আমি প্রাতে উঠিয়াই
‘ আয় আয়’ কাঁদিতেছে তেমনি সানাই।

 

ম্লানমুখী শেফালিকা পড়িতেছে ঝরি’
বিধবার হাসি সম-স্নিগ্ধ গন্ধে ভরি’!
নেচে ফেরে প্রজাপতি চঞ্চল পাখায়
দুরন্ত নেশায় আজি, পুষ্প-প্রগল্ভায়
চুম্বনে বিবশ করি’! ভোমোরার পাখা
পরাগে হলুদ আজি, অঙ্গে মধু মাখা।
উছলি’ উঠিছে যেন দিকে দিকে প্রাণ!
আপনার অগোচরে গেয়ে উঠি গান
আগমনী আনন্দের! অকারণে আঁখি
পু’রে আসে অশ্রু-জলে! মিলনের রাখী
কে যেন বাঁধিয়া দেয় ধরণীর সাথে!

 

পুষ্পঞ্জলি ভরি’ দু’টি মাটি মাখা হাতে
ধরণী এগিয়ে আসে, দেয় উপহার।
ও যেন কনিষ্ঠা মেয়ে দুলালী আমার!-
সহসা চমকি’ উঠি! হায় মোর শিশু
জাগিয়া কাঁদিছ ঘরে, খাওনি ক’ কিছু
কালি হ’তে সারাদিন তাপস নিষ্ঠুর,
কাঁদ’ মোর ঘরে নিত্য তুমি ক্ষুধাতুর!
পারি নাই বাছা মোর, হে প্রিয় আমার,
দুই বিন্দু দুগ্ধ দিতে!-মোর অধিকার
আনন্দের নাহি নাহি! দারিদ্র্য অসহ
পুত্র হ’য়ে জায়া হয়ে কাঁদে অহরহ
আমার দুয়ার ধরি! কে বাজাবে বাঁশি?
কোথা পাব আনন্দিত সুন্দরের হাসি?
কোথা পাব পুষ্পাসব?-ধুতুরা-গেলাস
ভরিয়া করেছি পান নয়ন-নির্যাস!….
আজো শুনি আগমনী গাহিছে সানাই,
ও যেন কাঁদিছে শুধু-নাই কিছু নাই!

 

দারিদ্র্য


চল্‌ চল্ চল্ - কাজী নজরুল ইসলাম


চল্‌ চল্ চল্

ঊর্দ্ধ গগনে বাজে মাদল,

নিম্নে উতলা ধরণী তল

অরুণ প্রাতের তরুণ দল

চল্‌ রে চল্‌ রে চল্‌

চল্‌ চল্ চল্ ।।

ঊষার দুয়ারে হানি আঘাত

আমরা আনিব রাঙা প্রভাত,

আমরা টুটিব তিমির রাত

বাঁধার বিন্ধ্যা চল।।

নব নবীনের গাহিয়া গান

সজীব করিব মহাশশ্মান,

আমরা দানিব নতুন প্রাণ

বাহুতে নবীন বল।।

চলরে নওজোয়ান,

শোনরে পাতিয়া কান

মৃত্যু তোরণ দুয়ারে দুয়ারে

জীবনের আহ্বান

ভাঙ্গরে ভাঙ্গ আগল

চল্‌ রে চল্‌ রে চল্‌

চল্‌ চল্ চল্।।


ছাত্রদলের গান - কাজী নজরুল ইসলাম

ছাত্রদলের গান 


. আমরা শক্তি আমরা বল
. আমরা ছাত্রদল |
মোদের         পায়ের তলায় মূর্ছে তুফান
. ঊর্ধ্বে বিমান ঝড়-বাদল |
. আমরা ছাত্রদল ||


মোদের        আঁধার রাতে বাধার পথে
. যাত্রা নাঙ্গা পায়,
আমরা শক্ত মাটী রক্তে রাঙাই
. বিষম চলার ঘাস |
. যুগে যুগে রক্তে মোদের
. সিক্ত হ’ল পৃথ্বীতল |
. আমরা ছাত্রদল ||


মোদের        কক্ষচ্যুত-ধূমকেতু-- প্রায়
. লক্ষ্যহারা প্রাণ
আমরা ভাগ্যদেবীর যজ্ঞবেদীর
. নিত্য বলিদান |
যখন লক্ষ্মীদেবী স্বর্গে উঠেন
. আমরা পশি নীল অতল !
. আমরা ছাত্রদল ||


আমরা ধরি মৃত্যু রাজার
. যজ্ঞ-ঘোড়ার রাশ,
মোদের মৃত্যু লেখে মোদের
. জীবন--ইতিহাস !
হাসির দেশে আমরা আনি
. সর্বনাশী চোখের জল
. আমরা ছাত্রদল ||


. সবাই যখন বুদ্ধি যোগায়
. আমরা করি ভুল !
. সাবধানীরা বাঁধ বাঁধে সব,
. আমরা ভাঙি কূল |
. দারুণ-রাতে আমরা তরুণ
. রক্তে করি পথ পিছল !
. আমরা ছাত্রদল || 


মোদের        চক্ষে জ্বলে জ্ঞানের মশাল,
. বক্ষে ভরা বাক্,
. কন্ঠে মোদের কুন্ঠাবিহীন
. নিত্য কালের ডাক |
আমরা তাজা খুনে লাল ক’রেছি
. সরস্বতীর শ্বেত কমল |
. আমরা ছাত্রদল || 


ঐ দারুণ উপপ্লবের দিনে
. আমরা দানি শির,
. মোদের মাঝে মুক্তি কাঁদে
. বিংশ শতাব্দীর !
মোরা             গৌরবেরি কান্না দিয়ে
. ভ’রেছি মা’র শ্যাম-আঁচল |
. আমরা ছাত্রদল ||


. আমরা রচি ভালোবাসার
. আশার ভবিষ্যৎ,
মোদের        স্বর্গ-পথের অভাস দেখায়
. আকাশ-ছায়াপথ !
. মোদের চোখে বিশ্ববাসীর
. স্বপ্ন দেখা হোক সফল |
. আমরা ছাত্রদল ||
:-: :-: :-:

কান্ডারী হুশিয়ার - কাজী নজরুল ইসলাম

Poet Kazi nazrul Islam
বিদ্রোহী কবি - কাজী নজরুল ইসলাম


কান্ডারী হুশিয়ার 



কোরাস :----
. দুর্গম গিরি, কান্তার মরু, দুস্তর পারাবার
. লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশীথে, যাত্রীরা হুশিয়ার !


দুলিতেছে তরী ফুলিতেছে জল, ভুলিতেছে মাঝি পথ,
ছিঁড়িয়াছে পাল কে ধরিবে হাল, আছে কার হিম্মৎ ?
কে আছ জোয়ান হও আগুয়ান হাঁকিছে ভবিষ্যৎ |
এ তুফান ভারী, দিতে হবে পাড়ি, নিতে হবে তরী পার ||


তিমির রাত্রি মাতৃমন্ত্রী সান্ত্রীরা সাবধান !
যুগযুগান্ত সঞ্চিত ব্যথা ঘোষিয়াছে অভিযান |
ফেনাইয়া উঠে বঞ্চিত বুকে পুঞ্জিত অভিমান,
ইহাদের পথে নিতে হবে সাথে দিতে হবে অধিকার ||


অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া জানে না সন্তরণ,
কান্ডারী ! আজি দেখিব তোমার মাতৃমুক্তি-পণ !
“হিন্দু না ওরা মুসলিম ?” ওই জিজ্ঞাসে কোন্ জন ?
কান্ডারী ! বল ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মা’র !


গিরি-সঙ্কট, ভীরু যাত্রীরা, গুরু গরজায় বাজ,
পশ্চাত-পথ-যাত্রীর মনে সন্দেহ জাগে আজ !
কান্ডারী ! তুমি ভুলিবে কি পথ ? ত্যজিবে কি পথ মাঝ ?
করে হানাহানি, তবু চল টানি’ নিয়াছ যে মহাভার !


কান্ডারী ! তব সন্মুখে ঐ পলাশীর প্রান্তর,
বাঙালীর খুনে লাল হ’ল যেথা ক্লাইভের খঞ্জর !
ঐ গঙ্গায় ডুবিয়াছে হায় ভারতের দিবাকর !
উদিবে সে রবি আমাদেরি খুনে রাঙিয়া পুনর্বার !


ফাঁসির মঞ্চে গেয়ে গেল যারা জীবনের জয়গান
আসি অলক্ষ্যে দাঁড়ায়েছে তারা, দিবে কোন বলিদান ?
আজি পরীক্ষা জাতির অথবা জাতের করিবে ত্রাণ ?
দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জল, কান্ডারী হুশিয়ার !


                 :-:  :-:  :-:


নতুনের গান - কাজী নজরুল ইসলাম

চল চল চল



চল চল চল!
ঊর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল
নিম্নে উতলা ধরণি তল,
অরুণ প্রাতের তরুণ দল
চল রে চল রে চল
চল চল চল।।
ঊষার দুয়ারে হানি' আঘাত
আমরা আনিব রাঙা প্রভাত,
আমরা টুটাব তিমির রাত,
বাধার বিন্ধ্যাচল।
নব নবীনের গাহিয়া গান
সজীব করিব মহাশ্মশান,
আমরা দানিব নতুন প্রাণ
বাহুতে নবীন বল!
চল রে নও-জোয়ান,
শোন রে পাতিয়া কান
মৃত্যু-তরণ-দুয়ারে দুয়ারে
জীবনের আহবান।
ভাঙ রে ভাঙ আগল,
চল রে চল রে চল
চল চল চল।।
ঊর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল
নিম্নে উতলা ধরণি তল,
অরুণ প্রাতের তরুণ দল
চল রে চল রে চল
চল চল চল।।
{ঊর্ধ্ব আদেশ হানিছে বাজ,
শহীদী-ঈদের সেনারা সাজ,
দিকে দিকে চলে কুচ-কাওয়াজ—
খোল রে নিদ-মহল!
কবে সে খেয়ালী বাদশাহী,
সেই সে অতীতে আজো চাহি'
যাস মুসাফির গান গাহি'
ফেলিস অশ্রুজল।
যাক রে তখত-তাউস
জাগ রে জাগ বেহুঁশ।
ডুবিল রে দেখ কত পারস্য
কত রোম গ্রিক রুশ,
জাগিল তা'রা সকল,
জেগে ওঠ হীনবল!
আমরা গড়িব নতুন করিয়া
ধুলায় তাজমহল!
চল্‌ চল্‌ চল্।}

আজ রক্ত-মাতাল উল্লাসে মাতি রে—

ধূমকেতু

কাজী নজরুল ইসলাম

আমি যুগে যুগে আসি, আসিয়াছি পুন মহাবিপ্লব হেতু

এই স্রষ্টার শনি মহাকাল ধূমকেতু!

সাত— সাতশো নরক-জ্বালা জলে মম ললাটে,

মম ধূম-কুণ্ডলী করেছে শিবের ত্রিনয়ন ঘন ঘোলাটে।

আমি অশিব তিক্ত অভিশাপ,

আমি স্রষ্টার বুকে সৃষ্টি-পাপের অনুতাপ-তাপ-হাহাকার—
আর মর্তে সাহারা-গোবি-ছাপ,
আমি অশিব তিক্ত অভিশাপ!


আমি সর্বনাশের ঝাণ্ডা উড়ায়ে বোঁও বোঁও ঘুরি শূন্যে,

আমি বিষ-ধূম-বাণ হানি একা ঘিরে ভগবান-অভিমুন্যে।

শোঁও শন-নন-নন-শন-নন-নন শাঁই শাঁই,

ঘুর্ পাক্ খাই, ধাই পাঁই পাঁই

মম পুচ্ছে জড়ায়ে সৃষ্টি;

করি উল্কা-অশনি-বৃষ্টি,—
আমি একটা বিশ্ব গ্রাসিয়াছি, পারি গ্রাসিতে এখনো ত্রিশটি।
আমি অপঘাত দুর্দৈব রে আমি সৃষ্টির অনাসৃষ্টি!


আমি আপনার বিষ-জ্বালা-মদ-পিয়া মোচড় খাইয়া খাইয়া

জোর বুঁদ হয়ে আমি চলেছি ধাইয়া ভাইয়া!

শুনি মম বিষাক্ত ‘রিরিরিরি’-নাদ

শোনায় দ্বিরেফ-গুঞ্জন সম বিশ্ব-ঘোরার প্রণব-নিনাদ!

ধূর্জটি-শিখ করাল পুচ্ছে

দশ অবতারে বেঁধে ঝ্যাঁটা করে ঘুরাই উচ্চে, ঘুরাই—
আমি অগ্নি-কেতন উড়াই!—


আমি যুগে যুগে আসি, আসিয়াছি পুন মহাবিপ্লব হেতু

এই স্রষ্টার শনি মহাকাল ধূমকেতু!


ঐ বামন বিধি সে আমারে ধরিতে বাড়ায়েছিল রে হাত

মম অগ্নি-দাহনে জ্বলে পুড়ে তাই ঠুঁটো সে জগন্নাথ!

আমি জানি জানি ঐ স্রষ্টার ফাঁকি, সৃষ্টির ঐ চাতুরী,

তাই বিধি ও নিয়মে লাথি মেরে, ঠুকি বিধাতার বুকে হাতুড়ি।

আমি জানি জানি ঐ ভুয়ো ঈশ্বর দিয়ে যা হয়নি হবে তাও!

তাই বিপ্লব আনি বিদ্রোহ করি, নেচে নেচে দিই গোঁফে তাও!
তোর নিযুত নরকে ফুঁ দিয়ে নিবাই, মৃত্যুর মুখে থুথু দি!
আর যে যত রাগে রে তারে তত কাল্-আগুনের কাতুকুতু দি।
মম তূরীয় লোকের তির্যক, গতি তূর্য গাজন বাজায়
মম বিষ নিশ্বাসে মারীভয় হানে অরাজক যত রাজায়!


কচি শিশু-রসনায় ধানি-লঙ্কার পোড়া ঝাল

আর বদ্ধ কারায় গন্ধক ধোঁয়া, এসিড, পটাশ, মোন্ছাল,

আর কাঁচা কলিজায় পচা ঘা’র সম সৃষ্টিরে আমি দাহ করি

আর স্রষ্টারে আমি চুষে খাই।

পেলে বাহান্ন-শও জাহান্নমেও আধা চুমুকে সে শুষে যাই!


আমি যুগে যুগে আসি আসিয়াছি পুন মহাবিপ্লব হেতু—

এই স্রষ্টার শনি মহাকাল ধূমকেতু!

আমি শি শি শি প্রলয়-শিশ্ দিয়ে ঘুরি কৃতঘ্নী ঐ বিশ্বমাতার শোকাগ্নি,

আমি ত্রিভুবন তার পোড়ায়ে মারিয়া আমিই করিব মুখাগ্নি!

তাই আমি ঘোর তিক্ত সুখে রে, একপাক ঘুরে বোঁও করে ফের দু’পাক নি!

কৃতঘ্নী আমি কৃতঘ্নী ঐ বিশ্বমাতার শোকাগ্নি!

পঞ্জর মম খর্পরে জ্বলে নিদারুণ যেই বৈশ্বানর—

শোন্ রে মর, শোন্ অমর!—

সে যে তোদের ঐ বিশ্বপিতার চিতা!

এ চিতাগ্নিতে জগদীশ্বর পুড়ে ছাই হবে, হে সৃষ্টি জানো কি তা?

কি বলো? কি বলো? ফের বলো ভাই আমি শয়তান-মিতা!

হো হো ভগবানে আমি পোড়াব বলিয়া জ্বালায়েছি বুকে চিতা!
ছোট শন শন শন ঘর ঘর ঘর সাঁই সাঁই!
ছোট পাঁই পাঁই!
তুই অভিশাপ তুই শয়তান তোর অনন্তকাল পরমাই।
ওরে ভয় নাই তোর মার নাই!!
তুই প্রলয়ঙ্কর ধূমকেতু,
তুই উগ্র ক্ষিপ্ত তেজ-মরীচিকা ন’স্ অমরার ঘুম-সেতু
তুই ভৈরব ভয় ধূমকেতু!
আমি যুগে যুগে আসি আসিয়াছি পুন মহাবিপ্লব হেতু
এই স্রষ্টার শনি মহাকাল ধূমকেতু!


ঐ ঈশ্বর-শির উল্লঙ্ঘিতে আমি আগুনের সিঁড়ি,

আমি বসিব বলিয়া পেতেছে ভবানী ব্রহ্মার বুকে পিঁড়ি!

খ্যাপা মহেশের বিক্ষিপ্ত পিনাক, দেবরাজ-দম্ভোলি

লোকে বলে মোরে, শুনে হাসি আমি আর নাচি বব-বম্ বলি!

এই শিখায় আমার নিযুত ত্রিশূল বাশুলি বজ্র-ছড়ি

ওরে ছড়ানো রয়েছে, কত যায় গড়াগড়ি!
মহা সিংহাসনে সে কাঁপিছে বিশ্ব-সম্রাট নিরবধি,
তার ললাটে তপ্ত অভিশাপ-ছাপ এঁকে দিই আমি যদি!
তাই টিটকিরি দিয়ে হাহা হেসে উঠি,
সে হাসি গুমরি লুটায়ে পড়ে রে তুফান ঝন্ঝা সাইক্লোনে টুটি!


আমি বাজাই আকাশে তালি দিয়া ‘তাতা-উর্-তাক্’

আর সোঁও সোঁও করে প্যাঁচ দিয়ে খাই চিলে-ঘুড়ি সম ঘুরপাক!

মম নিশাস আভাসে অগ্নি-গিরির বুক ফেটে ওঠে ঘুত্কার

আর পুচ্ছে আমার কোটি নাগ-শিশু উদ্গারে বিষ-ফুত্কার!


কাল বাঘিনী যেমন ধরিয়া শিকার

তখনি রক্ত শোষে না রে তার,

দৃষ্টি-সীমায় রাখিয়া তাহারে উগ্রচণ্ড-সুখে

পুচ্ছ সাপটি খেলা করে আর শিকার মরে সে ধুঁকে!

তেমনি করিয়া ভগবানে আমি

দৃষ্টি-সীমায় রাখি দিবাযামী
ঘিরিয়া ঘিরিয়া খেলিতেছি খেলা, হাসি পিশাচের হাসি
এই অগ্নি-বাঘিনী আমি যে সর্বনাশী!


আজ রক্ত-মাতাল উল্লাসে মাতি রে—

মম পুচ্ছে ঠিকরে দশগুণ ভাতি,

রক্ত রুদ্র উল্লাসে মাতি রে!

ভগবান? সে তো হাতের শিকার!— মুখে ফেনা উঠে মরে!

ভয়ে কাঁপিছে, কখন পড়ি গিয়া তার আহত বুকের পরে!

অথবা যেন রে অসহায় এক শিশুরে ঘিরিয়া
অজগর কাল-কেউটে সে কোনো ফিরিয়া ফিরিয়া
চায়, আর ঘোরে শন্ শন্ শন্,
ভয়-বিহ্বল শিশু তার মাঝে কাঁপে রে যেমন—
তেমনি করিয়া ভগবানে ঘিরে
ধূমকেতু-কালনাগ অভিশাপ ছুটে চলেছি রে;
আর সাপে-ঘেরা অসহায় শিশু সম
বিধাতা তাদের কাঁপিছে রুদ্র ঘূর্ণির মাঝে মম!


আজিও ব্যথিত সৃষ্টির বুকে ভগবান কাঁদে ত্রাসে,

স্রষ্টার চেয়ে সৃষ্টি পাছে বা বড় হয়ে তারে গ্রাসে!