-- সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত
ছিপখান তিন-দাঁড়--তিনজন মাল্লাচৌপর দিন-ভোরদ্যায় দূর-পাল্লা !পাড়ময় ঝোপঝাড়জঙ্গল,--জঞ্জাল,জলময় শৈবালপান্নার টাঁকশাল ।কঞ্চির তীর-ঘরঐ-চর জাগছে,বন-হাঁস ডিম তারশ্যাওলায় ঢাকছে ।চুপ চুপ--ওই ডুবদ্যায় পান্ কৌটিদ্যায় ডুব টুপ টুপঘোমটার বৌটি !ঝকঝক কলসীরবক্ বক্ শোন্ গোঘোমটার ফাঁক বয়মন উন্মন গো ।তিন-দাঁড় ছিপখানমন্থর যাচ্ছে,তিনজন মাল্লায়কোন গান গাচ্ছে ?রূপশালি ধান বুঝিএইদেশে সৃষ্টি,ধুপছায়া যার শাড়ীতার হাসি মিষ্টি ।মুখখানি মিষ্টিরেচোখদুটি ভোমরাভাব-কদমের--ভরারূপ দেখ তোমরা !ময়নামতীর জুটিওর নামই টগরী,ওর পায়ে ঢেউ ভেঙেজল হোলো গোখরী !ডাক পাখী ওর লাগি'ডাক ডেকে হদ্দ,ওর তরে সোঁত-জলেফুল ফোটে পদ্ম ।ওর তরে মন্থরেনদ হেথা চলছে,জলপিপি ওর মৃদুবোল বুঝি বোলছে ।দুইতীরে গ্রামগুলিওর জয়ই গাইছে,গঞ্জে যে নৌকা সেওর মুখই চাইছে ।আটকেছে যেই ডিঙাচাইছে সে পর্শ,সঙ্কটে শক্তি ওসংসারে হর্ষ ।পান বিনে ঠোঁট রাঙাচোখ কালো ভোমরা,রূপশালী-ধান-ভানারূপ দেখ তোমরা* * * * * * *পান সুপারি ! পান সুপারি !এইখানেতে শঙ্কা ভারি,পাঁচ পীরেরই শীর্ণি মেনেচলরে টেনে বৈঠা হেনে ;বাঁক সমুখে, সামনে ঝুঁকেবাঁয় বাঁচিয়ে ডাইনে রুখেবুক দে টানো, বইটা হানো--সাত সতেরো কোপ কোপানো ।হাড়-বেরুনো খেজুরগুলোডাইনী যেন ঝামর-চুলোনাচতে ছিল সন্ধ্যাগমেলোক দেখে কি থম্ কে গেল ।জমজমাটে জাঁকিয়ে ক্রমেরাত্রি এল রাত্রি এল ।ঝাপসা আলোয় চরের ভিতেফিরছে কারা মাছের পাছে,পীর বদরের কুদরতিতেনৌকা বাঁধা হিজল-গাছে ।আর জোর দেড় ক্রোশ--জোর দের ঘন্টা,টান ভাই টান সব--নেই উত্কণ্ঠা ।চাপ চাপ শ্যাওলারদ্বীপ সব সার সার,বৈঠৈর ঘায়ে সেইদ্বীপ সব নড়ছে,ভিল্ ভিলে হাঁস তায়জল-গায় চড়্ ছে ।ওই মেঘ জমছে,চল্ ভাই সমঝে,গান গাও দাও শিশ,বকশিশ ! বকশিশ !খুব জোর ডুব-জলবয় স্রোত ঝিরঝির,নেই ঢেউ কল্লোল,নয় দুর নয় তীর ।নেই নেই শঙ্কা,চল্ সব ফুর্তি,বকশিশ টঙ্কা,বকশিশ ফুর্তি ।ঘোর-ঘোর সন্ধ্যায়,ঝাউ-গাছ দুলছে,ঢোল-কলমীর ফুলতন্দ্রায় ঢুলছে ।লকলক শর-বনবক তায় মগ্ন,চুপচাপ চারদিক--সন্ধ্যার লগ্ন ।চারদিক নিঃসাড়,ঘোর-ঘোর রাত্রি,ছিপ-খান তিন-দাঁড়,চারজন যাত্রি ।* * * *জড়ায় ঝাঁঝি দাঁড়ের মুখেঝউয়ের বীথি হাওয়ায় ঝুঁকেঝিমায় বুঝি ঝিঁঝিঁর গানে--স্বপন পানে পরাণ টানে।তারায় ভরা আকাশ ওকিভুলোয় পেয়ে ধূলোর পরেলুটিয়ে পল আচম্বিতেকুহক-মোহ-মন্ত্র-ভরে !* * * *কেবল তারা ! কেবল তারা !শেষের শিরে মানিক পারা,হিসাব নাহি সংখ্যা নাহিকেবল তারা যেথায় চাহি ।কোথায় এল নৌকাখানাতারার ঝড়ে হই রে কাণা,পথ ভুলে কি এই তিমিরেনৌকা চলে আকাশ চিরে !জ্বলছে তারা ! নিভছে তারা !মন্দাকিনীর মন্দ সোঁতায়,যাচ্ছে ভেসে যাচ্ছে কোথায়জোনাক যেন পন্থা-হারা ।তারায় আজি ঝামর হাওয়া-ঝামর আজি আঁধার রাতি,অগুন্ তি অফুরান তারাজ্বালায় যেন জোনাক-বাতি ।কালো নদীর দুই কিনারেকল্পতরু কুঞ্জ কি রে ?ফুল ফুটেছে ভারে ভারে--ফুল ফুটেছে মাণিক হীরে ।বিনা হাওয়ায় ঝিলমিলিয়েপাপড়ি মেলে মাণিক-মালা;বিনি নাড়ায় ফুল ঝরিছেফুল পড়িছে জোনাক জ্বালা ।চোখে কেমন লগছে ধাঁধা--লাগছে যেন কেমন পারা,তারাগুলোই জোনাক হলকিম্বা জোনাক হল তারা ।নিথর জলে নিজের ছায়াদেখছে আকাশ ভরা তারায়,ছায়া-জোনাক আলিঙ্গিতেজলে জোনাক দিশে হারায় ।দিশে হারায় যায় ভেসে যায়স্রোতের টানে কোন্ দেশে রে ?মরা গাঙ আর সুর-সরিত্এক হয়ে যেথায় মেশে রে !কোথায় তারা ফুরিয়েছে, আরজোনাক কোথা হয় সুরু যেনেই কিছুরই ঠিক ঠিকানাচোখ যে আলা রতন উঁছে ।আলেয়াগুলো দপদপিয়েজ্বলছে নিবে, নিবছে জ্বলে',উল্কোমুখী জিব মেলিয়েচাটছে বাতাশ আকাশ-কোলে !আলেয়া-হেন ডাক-পেয়াদাআলেয়া হতে ধায় জেয়াদাএকলা ছোটে বন বাদাড়েল্যাম্পো-হাতে লক্ ড়ি ঘাডে;সাপ মানে না, ভাঘ জানে না,ভূতগুলো তার সবাই চেনা,ছুটছে চিঠি পত্র নিয়েরণরণিয়ে হনহনিয়ে ।বাঁশের ঝোপে জাগছে সাড়া,কোল্-কুঁজো বাঁশ হচ্ছে খাড়া,জাগছে হাওয়া জলের ধারে,চাঁদ ওঠেনি আজ আঁধারে !শুকতারাটি আজ নিশীথেদিচ্ছে আলো পিচকিরিতে,রাস্তা এঁকে সেই আলোতেছিপ চলেছে নিঝুম স্রোতে ।ফিরছে হাওয়া গায় ফুঁ-দেওয়া,মাল্লা মাঝি পড়ছে থকে;রাঙা আলোর লোভ দেখিয়েধরছে কারা মাছগুলোকে !চলছে তরী চলছে তরী--আর কত পথ ? আর ক'ঘড়ি ?এই যে ভিড়াই, ওই যে বাড়ী,ওই যে অন্ধকারের কাঁড়ি--ওই বাঁধা-বট ওর পিছন্দেখছ আলো ? ঐতো কুঠিঐখানেতে পৌঁছে দিলেইরাতের মতন আজকে ছুটি।ঝপ ঝপ তিনখানদাঁড় জোর চলছে,তিনজন মাল্লারহাত সব জ্বলছে;গুরগুর মেঘ সবগায় মেঘ মল্লার,দূর-পাল্লার শেষহাল্লাক্ মাল্লার !
ছিপখান তিন দাঁড়--তিনজন মাল্লা |
No comments:
Post a Comment